এস. এম. মনিরুজ্জামান মিলন, ঠাকুরগাঁও
গত বছরের ২৩ জুন ঘটা করে দলের পঁচাত্তর বছরপূর্তি উদযাপন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেদিন ঠাকুরগাঁওয়ে আনন্দ র?্যালিতে নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। অথচ মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে যায়। ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের দাপুটে নেতাকর্মীরাও প্রাণ রক্ষার্থে আত্মগোপণে চলে যায়। ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনাসহ একাধিক মামলা কাঁধে নিয়ে গ্রেফতার আতঙ্কে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন গ্রামের বাড়িতে কিংবা ঢাকা শহরে। সরকার পতনের সাড়ে পাঁচ মাস পার হলেও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন নেতাকর্মীরা। এমন অবস্থায় গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে চরম নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বেঁচে থাকার জন্য নেতাকর্মীদের অনেকেই রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন। এরইমধ্যে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলী সদস্য ও ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম, তার বড় ছেলে দ্বাদশ সংসদের সাবেক সদস্য মাজহারুল ইসলাম সুজন, ঠাকুরগাঁও পৌরসভার সাবেক মেয়র আঞ্জুমান আরা বেগম বন্যা, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত সমীর গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি হয়েছেন।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চরম হতাশায় ভুগছেন। তাদের অনেকেই এখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তারা তাদের নামও প্রকাশ করতে চাননি। তবে আখানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যনা ও আওয়ামী লীগ নেতা রোমান বাদশা ও ঠাকুরগাঁও পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. মানিক হোসেনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও পরবর্তীতে আদালত তাদের জামিন দেয়। বর্তমানে তারা দুজনেই মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ইউনিয়ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জানান, আমাদের দলের এখন দিশেহারা বিপর্যস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। ৫ মাস হয়ে গেলো অথচ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে আমরা নিঃস্ব। তারা এ-ও বলেন, কোটি কোটি টাকা কামালো নেতারা আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের।
আরেক কর্মী বলেন, আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি, কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। আর আয় না থাকলে সংসারের কী অবস্থা হয়, তা তো বুঝতেই পারছেন। সংসার চালাতে না পেরে তার স্ত্রী প্রতিনিয়তই ফোন করে কান্নাকাটি করে। এভাবে কতদিন থাকবে? ভাবতে গেলেই কান্না আসে। মনে হচ্ছে, রাজনীতি করাই পাপ হয়েছে। তাই আর রাজনীতি করব না বলে সিদ্ধান্ত নিছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঠাকুরগাঁও শহরের চৌরাস্তায় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ক্যাডাররা রাস্তায় নামেন। পাশাপাশি সমর্থকরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা ও ইটপাটকেল ছোঁড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পরপর জেলার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর, লুট, অগ্নিসংযোগে ধ্বংসযজ্ঞে রূপ নেয়। এখন পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনে হামলায় নিহত, দোকানপাট ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নাশকতার অভিযোগে ডজনখানেক মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের হেভিওয়েট নেতাদের। সর্বশেষ ১ জানুয়ারি রাতে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ঠাকুরগাঁও সদর থানায় ২৯৪ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরো ৫০০ জনের নামে একটি মামলা দায়ের করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ কুমার কুন্ডু। এ মামলায় মৃত ব্যক্তি ও স্কুলছাত্রের নামসহ নানা অসংগতি ও গণহারে আসামি করা নিয়েও আলোচনা এখন তুঙ্গে। আসামি করা হয় পৌর শহরের বাজারপাড়া এলাকার মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে মৃত শরিফুল হাসান ওরফে বাপ্পীকে। তিনি সাড়ে ৬ বছর আগে ব্রেন স্ট্রোকে দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। শুধু মৃত ব্যক্তি নয় আসামি করা হয় দুই স্কুল শিক্ষার্থীকেও। দল ক্ষমতা হারানোর পর গত পাঁচ মাসে ঠাকুরগাঁও জেলাসহ অনেক ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যারা বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তারা এখনও এলাকায় ফিরতে পারেননি। থানা পর্যায়ের এক নেতা জানান, পাঁচ মাস হয়ে গেলো বাড়িতে যেতে পারছি না, পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কবে এলাকায় ফিরতে পারব তাও জানি না। স্থানীয় বাজারে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল, গত ৫ আগস্টের পর সবগুলোই দখল করে নেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। পরিবার নিয়ে সামনে কীভাবে চলব, কোথায় দাঁড়াব, সেটা নিয়েই চিন্তায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের এই নেতা। হামলার ভয়ে নিজেরা গা ঢাকা দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশিরভাগের পরিবার-পরিজন তাদের নিজ নিজ এলাকাতে রয়েছেন। তবে আয়-রোজগার না থাকায় সংসার চালাতে গিয়ে অনেকের স্ত্রী-সন্তানরা বিপাকে পড়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। টাকা-পয়সা যা রেখে আসছিলাম সব এই কয়দিনে শেষ হয়ে গেছে। এখন বাজার করার মতো অবস্থাও নেই। ঘরে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে তারা কী খাবে? মোবাইল করে আমার বউ কান্নাকাটি করে বলছিলেন ভুল্লী থানার এক আওয়ামী লীগ কর্মী। এ অবস্থায় সপ্তাহখানেক আগে সন্তানদের নিয়ে তার স্ত্রী বাবার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে বলে জানান তিনি। কিন্তু এভাবে কতদিন থাকবে? ভাবতে গেলেই কান্না আসে। মনে হচ্ছে, রাজনীতি করাই পাপ হয়েছে। তাই আর রাজনীতি করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। পালিয়ে থাকা অবস্থাতেই একের পর এক মামলায় আসামি হচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ঠাকুরগাঁও আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাকে যে কতগুলো মামলায় আসামি করা হয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই। যেখানে যত মামলা হচ্ছে, সবখানেই অকারণে আমার নাম ঢোকানো হচ্ছে। দেশে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসলে আদালতে গিয়ে মামলার জামিন নিবেন বলেও জানান তিনি। থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর সহিংসতার ঘটনায় ঠাকুরগাঁওয়ের ১০টি মামলা হয়েছে। বাকি থানাগুলোতে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে মামলা ১০টি হলে নামসহ প্রতিটি মামলায় অন্তত শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, সহযোগিতা, হত্যা ও হত্যার চেষ্টা, উসকানিদাতা, পরিকল্পনাকারী ইত্যাদির অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রায় সব মামলাতে সাবেক সংসদ সদস্যসহ জেলা আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতাদের আসামি করা হয়েছে। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুর রহমান বলেন, ৫ আগস্টের পর থানায় যে সব মামলা হয়েছে এবং যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। বাকিরাও হবেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata